রিপোর্টার্স বিডি নিউজ ডেস্ক : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক স্লিপ খবরও প্রকাশ হয়নি সেই দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে শুধু নেতৃত্বদানই নয়, ‘শোষিতের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছিল বিশ্বময়।
বাঙ্গালির মুক্তির এই সারথীকে হত্যার পর কোনো পত্রিকায় আলাদা একটি সংবাদ পর্যন্ত পরিবেশন হয়নি। ওই বছরের ১৬ আগস্টের ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকা তালাশ করে এই চিত্র দেখা গেছে।
১৬ আগস্টের ইত্তেফাক পত্রিকায় ছয় কলামে প্রধান শিরোনাম হয় ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দখল’। শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে ‘শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন’।
ওই দিনের ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পাতায় মোট ১৬ টি খবর পরিবেশন হয়। এর মধ্যে সবগুলো খবরই ছিল মোশতাকের ক্ষমতাগ্রহণকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কোথায়ও জাতির জনককে হত্যার খবর পরিবেশন হয়নি।
পত্রিকার প্রথম পাতায় তিনটি ছবি প্রকাশ হয়। লিড নিউজের সঙ্গে প্রকাশিত ছবিতে খন্দকার মোশতাক আহমদকে শপথবাক্য পাঠ করান তৎকালীন অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন।
দ্বিতীয় ছবিতে তৎকালীন তিন বাহিনীর প্রধানদের ওই সরকারের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি তোলে ধরা হয়। এবং তৃতীয় ছবিতে বঙ্গভবনে ক্ষমতা দখলকারী নয়া রাস্ট্রপতির মোনাজাতের দৃশ্য দেখানো হয়।
ওই সময়ে ইত্তেফাকের আট পৃষ্ঠার নিয়মিত সম্পাদকীয় ছাপা হতো দ্বিতীয় পাতায়। কিন্তু ১৬ আগষ্ট প্রথম পাতায় লিড নিউজের বামপাশে বিশেষ সম্পাদকীয় ছাপা হয়। তাতে খন্দাকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ হিসেবে অভিহিত করে খন্দকার মোশতাককে ‘প্রবীণ জননায়ক ’ উল্লেখ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চলা বিগত তিন বছর সময়কে ‘গভীর হতাশা ও বঞ্চনার সময় হিসেবে উল্লেখ করে সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘গণমানুষের ভাগ্যোন্নোয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্খায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে’।
‘সোনার বাংলার সোনার মানুষদের চরম হতাশায় ঠেলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
‘এক মহাক্রান্তিকালের জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে তাহাকে সুসংহত করিতে হইলে জনগণের প্রতি অর্জিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সকলকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া যাইতে হবে’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
৪৪ শব্দের দাফন সংবাদ
১৭ আগষ্ট ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামের (একদম বাম পাশে) মধ্যাংশে আনুমানিক এক কলাম তিন ইঞ্চি পরিমাণের জায়গা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দাফনের খবর দেয়া হয়।
‘পূর্ণমর্যাদায় স্বগ্রামে পরলোকগত রাষ্ট্রপতির দাফন সম্পন্ন’ এই শিরোনামে পরিবেশিত সংবাদটির শব্দ সংখ্যা ৩৭, শিরোনামসহ শব্দ সংখ্যা ৪৪। । দাফনের খবরে উল্লেখ করা হয়, ‘পরলোকগত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ গতকাল (শনিবার) বিমানে করিয়া তার নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় (ফরিদপুর) লইয়া যাওয়া হয় এবং তাহাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয়। একজন সহকারী মুখপাত্রের বরাত দিয়া বাসস এই খবর পরিবেশন করে’। (ইত্তেফাক, ১৭ আগস্ট ১৯৭৫)
দুটি পত্রিকায় একই সংবাদ
১৬ আগষ্টের ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো প্রায় একই রকম। শুধু সামান্য ভাষাগত এবং মেকআপের পার্থক্য। এ থেকে বুঝা যায়, এগুলো হয়তো ওই সময়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিশেষ জায়গা থেকে পাঠানো সংবাদ।
তবে, অবজারভারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি ব্যানার লিডের নিচে সাব-লিড হিসেবে পরিবেশিত হয়। কিন্তু তার হত্যার খবরে এই ইংরেজী দৈনিকটিতেও আলাদা কোনো খবর পরিবেশন করা হয়নি।
এদিন ওই সময়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের অন্যান্য সংবাদ শিরোনামগুলো ছিল :
‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’
‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’
‘নয়া সরকারের জন্য বিশেষ মোনাজাত’ এই শিরোনামের সংবাদের পাশে একটি ছবি পরিবেশন করা হয়। এতে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ মোনাজাতে খন্দকার মোশতাক এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরের ছবিও রয়েছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’
বিদেশী দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকিবে’
‘নয়া সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি’
‘অচল নোটের আট হাজার টাকা ফেরত’
‘বি এ সিদ্দিকী রেডক্রসের চেয়ারম্যান’
লন্ডস্থ হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ’
‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’
‘বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন’
‘ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপারদের প্রতি নির্দেশ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন Blogger Facebook